ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল দ্বীপ জেলা ভোলা। ১৯৭০ সালের আজকের এই দিনে ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় ইতিহাসে নেমে এসেছিল ভয়াবহ প্রলয়।
বিশেষ করে দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরায় সেই রাতে পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তেই বিলীন হয় শত শত গ্রাম, প্রাণ হারান লক্ষাধিক মানুষ।
উপকূল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মনপুরায় ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে রেলি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মনপুরা উপকূল ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা শামসুদ্দিন মোল্লা বলেন “৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে কোন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি আজও। এদিনে আমরা মনপুরার অনেককে হারিছি। প্রশাসন মনপুরায় টেকশয় বেড়ি বাঁধ নির্মান সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবে আমরা আশা করি।”
রিপোর্টাস ইউনিটির সভাপতি মহিব্বুল্যাহ ইলিয়াছ বলেন, ৭০ সালের বন্যায় ভোলা জেলায় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মারা যার মধ্যে মনপুরাতে প্রায় বিশ হাজার মানুষ মারা যায়।” আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।”
মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়েই তছনছ হয়ে যায় ভোলার জনপদ। সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে জানা যায়, শুধু ভোলা জেলাতেই প্রাণ হারান প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।
সেদিনের সেই মৃত্যুপুরীর স্মৃতি আজও কাঁদায় ভোলার আকাশ-বাতাস।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর গভীর রাতে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ও ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে ভোলা ও আশপাশের উপকূলীয় এলাকায়।
এক রাতের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অসংখ্য গ্রাম, হারিয়ে যায় মানুষ, গবাদি পশু, জমিজমা ও ফসল।
ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা, দৌলতখান, লালমোহন, তজুমদ্দিনসহ পুরো দ্বীপজুড়ে সৃষ্টি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।
পরদিন সকালে নদী-খাল-বিলজুড়ে ভাসতে থাকে লাশের সারি, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি ও নিঃস্ব মানুষের আহাজারিতে কেঁপে ওঠে চারপাশ।
স্থানীয় প্রবীণ সবুরা খাতুন জানান ৭০ সালে আমি ৩ সন্তানের জননী। সেই দিন ছিল কার্তিক মাসের ১১ তারিখ রমজান মাস ইফতারের আগে হালকা হালকা বাতাস ছিল। সন্ধার পর থেকে বাতাসের পরিমান বেড়ে যায়। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে প্রচন্ড বাতাসে ঘরের চালটি উড়ে যায়। এরপর হঠাৎ জোয়ারের পানি ২০-৩০ ফুট বেড়ে যায়। যার ফলে ঘরেটি পানিতে তলিয়ে যায়। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় শামসুল পিয়নের বাড়িতে । এই বন্যায় আমার শশুড় বাড়ির ১১জনের মধ্যে আমি একাই বেছে ছিলাম। আমার স্বামী, ৩ সন্তান,শশুর,শাশুড়ী, দেবড়,ননদ ও ৫ ভাইসহ অনেক আপনজনকে হারায়। সেদিন সকালে হাজার হাজার লাশ রাস্তায় পড়ে ছিল।
সাংবাদিকদের সাথে সেদিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তার চোখ গড়িয়ে অশ্রু জড়তে দেখা যায়।
স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, “সেদিন রাতটা ছিল এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। বাতাসের গর্জন, ঢেউয়ের গতি আর মানুষের চিৎকারে মনে হয়েছিল পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে।”
প্রলয়ের সেই রাতে অনেকে প্রিয়জনকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই হারিয়ে যান চিরতরে।
ভাসমান লাশে ভরে গিয়েছিল নদী-খাল, হাওয়ায় ভাসছিল লবণাক্ত জলের গন্ধ আর কান্নার আওয়াজ।
অসংখ্য শিশু হয়েছিল অনাথ, বহু পরিবার হারিয়েছিল তাদের সকল সদস্য।
দীর্ঘ ৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ভোলার মানুষ ভুলতে পারেনি সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি।
প্রতি বছর ১২ নভেম্বর এলেই জেগে ওঠে পুরনো ক্ষত, আর ফিরে আসে প্রিয়জন হারানোর কান্না।
আজও ভোলার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা ও শ্রদ্ধা নিবেদন কর্মসূচি।
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ অধ্যায়।
যাদের প্রাণহানিতে সমুদ্র হয়েছিল লাল, যাদের স্মৃতিতে গড়া ভোলার প্রতিটি ঘর। তাদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও আত্মার মাগফিরাত কামনা।